মহাসপ্তমী ২০২৫: বাংলায় শ্রী শ্রী চণ্ডী পূজার সূচনার মহিমা ও তাৎপর্য
আপডেট করা হয়েছে: ২৯ সেপ্টেম্বর, সকাল ১১:৩৪
মেটা ডেস্ক্রিপশন: মহাসপ্তমী ২০২৫ কবে? জানুন বাংলায় মহাসপ্তমীর সঠিক তারিখ, পূজার বিধি, মহাত্ম্য, পারিবারিক আচার ও কল্পবৃক্ষের কাহিনী। ডুরগা পূজার তৃতীয় দিনের সম্পূর্ণ গাইড।
শারদীয় দুর্গোৎসবের তৃতীয় দিন মহাসপ্তমী হল দেবী দুর্গার সক্রিয় উপাসনার সূচনাদিন। এই দিন থেকেই মূলত চণ্ডী পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় এবং বাঙালি হৃদয়ে উৎসবের রেশ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ২০২৫ সালে মহাসপ্তমী পালন করা হবে ২৫শে সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার।
এই ব্যাপক নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব মহাসপ্তমীর গভীর তাৎপর্য, ঐতিহ্যবাহী পূজার রীতিনীতি, এবং বর্তমান সময়ে এর প্রাসঙ্গিকতা।
মহাসপ্তমী ২০২৫: তারিখ ও মুহূর্ত
মহাসপ্তমী তারিখ: ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বৃহস্পতিবার)
নবপত্রিকা প্রবেশ: সকাল বেলা (সঠিক সময় পূজার তিথি অনুসারে স্থির হয়)
কল্পবৃক্ষ পূজা: সকালে
সপ্তমী পূজার সময়: সকাল থেকে দুপুর
নোট: হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, সপ্তমী তিথি শুরু হতে পারে ২৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত থেকেই। তাই কিছু মণ্ডপে অল্পবিস্তর পূজা ২৪ তারিখ সন্ধ্যায়ও শুরু হয়ে যেতে পারে। তবে মূল আনুষ্ঠানিকতা ও নবপত্রিকা প্রবেশ ২৫ সেপ্টেম্বর সকালেই সম্পন্ন হবে।
মহাসপ্তমীর পৌরাণিক কাহিনী ও তাৎপর্য
মহাসপ্তমীর দিন থেকেই দেবী দুর্গা নবদুর্গা রূপে আবির্ভূত হন। পৌরাণিক কথিত আছে, এই দিনেই দেবী পার্বতী দুষ্ট অসুরদের বিনাশের জন্য নবশক্তির আধার রূপে আবির্ভূতা হন। 'মহাসপ্তমী' নামটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে এর গাম্ভীর্য – 'মহা' অর্থ মহান ও 'সপ্তমী' হল সপ্তম দিন।
এই দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল দেবীর চক্ষুদান। বিশ্বাস করা হয়, মহাসপ্তমীর দিন স্নান-যোগের মাধ্যমে দেবীর চক্ষুদান করা হয় এবং এর মধ্য দিয়েই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘটে। দেবী তখন শুধু মাটি ও খড়ের পুতুল নন, তিনি হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ জাগ্রত মাতৃরূপিণী।
নবপত্রিকা বা কল্পবৃক্ষ: প্রকৃতির নবশক্তির প্রতীক
মহাসপ্তমীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন অনুষ্ঠান হল নবপত্রিকা প্রবেশ। ন'টি গাছের পাতা বা লতা-গুল্মকে একত্রে বেঁধে একটি সজ্জিত পোশাক পরিয়ে, সধবা নারীর মতো সাজিয়ে, ঢাকের বাদ্যে শোভাযাত্রা সহকারে মণ্ডপে প্রবেশ করানো হয়। একে colloquially "কলাবউ" স্নানও বলা হয়।
নবপত্রিকায় কোন ন'টি উদ্ভিদ থাকে?
১. কলা (কদলী) – দেবী ব্রাহ্মণী
২. কচু – দেবী কালিকা
৩. হলুদ – দেবী দূর্গা
৪. জয়ন্তী – দেবী কার্তিকী
৫. বেল – দেবী শিবা
৬. ডালিম (দাড়িম্ব) – দেবী রক্তদন্তিকা
৭. অশোক – দেবী শোকরহিতা
৮. মান – দেবী চামুণ্ডা
৯. ধান (ঢেঁকি শাক) – দেবী লক্ষ্মী
এই নবপত্রিকা হল নবশক্তির, নবান্নের এবং প্রকৃতির সাথে মানুষের আত্মিক যোগসূত্রের প্রতীক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে দেবী শুধু মন্দিরে বা মণ্ডপে নন, তিনি প্রতিটি গাছের পাতায়, লতায়-গুল্মে বিরাজমান।
মহাসপ্তমী পূজার বিধি ও ধাপ
মহাসপ্তমীর পূজা অত্যন্ত জটিল ও বিস্তৃত। মূলত এটি চণ্ডী পূজার অংশ।
১. প্রতিপদ পূজা: সপ্তমীর দিন সকালে প্রথমে প্রতিপদ পূজা সম্পন্ন করা হয়।
২. নবপত্রিকা প্রতিষ্ঠা: কল্পবৃক্ষ বা নবপত্রিকাকে দেবীর ডান পাশে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
৩. সপ্তমী পূজার অঙ্গ: এরপর শুরু হয় মূল সপ্তমী পূজা। এদিন ১০৮টি শাপলো ফুল দিয়ে দেবীর পূজা করার রীতি রয়েছে।
৪. মহাস্নান: বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে দেবী ও নবপত্রিকার মহাস্নান করানো হয়। এই স্নানে ব্যবহৃত হয় দুধ, দই, মধু, গঙ্গাজল, গুঁড়ো চন্দন সহ নানাবিধ পবিত্র দ্রব্য।
৫. বস্ত্র ও অলংকার অর্পণ: স্নানের পর দেবী ও নবপত্রিকাকে নতুন বস্ত্র ও অলংকার পরানো হয়।
৬. পুষ্পাঞ্জলি: সকাল বা সন্ধ্যায় ভক্তরা দেবীকে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন। এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সরল অনুষ্ঠান।
মহাসপ্তমীর বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান
কলাবউ স্নান: বাড়ির মহিলারা সকাল সকাল স্নান সেরে নবপত্রিকা বা কলাবউ-কে স্নান করানোর রীতিও রয়েছে অনেক পরিবারে।
প্রসাদ বিতরণ: এই দিন থেকেই বাড়িতে বাড়িতে প্রসাদ বিতরণের ধুম পড়ে যায়। নারকেল নাডু, লাড্ডু, ফলারি থেকে শুরু করে ভোগের প্রস্তুতি চলে জোরেশোরে।
অনাহার ব্রত: অনেক ভক্ত এই দিন নিষ্ঠার সাথে উপবাস রাখেন এবং সন্ধ্যায় পূজা শেষে প্রসাদ গ্রহণ করেন।
আধুনিক সমাজে মহাসপ্তমীর গুরুত্ব
মহাসপ্তমী কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয়, এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক একতারও প্রতীক।
সামাজিক মেলবন্ধন: এই দিনে বাড়ি-বাড়ি প্যান্ডেল hopping-এর ধুম পড়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন একসাথে হয়ে বিভিন্ন মণ্ডপে দেবী দর্শনে বের হন।
সাংস্কৃতিক জাগরণ: মহাসপ্তমী থেকেই মূল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন – ধামালি নাচ, ঢাকের প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ইত্যাদির সূচনা হয়।
নারীশক্তির আরাধনা: নবপত্রিকা রূপে প্রকৃতির আরাধনা এবং দেবী দুর্গার পূজা মূলত নারীশক্তিরই পূজা। এটি সমাজে নারীর সম্মান ও মর্যাদাকে আরও সুদৃঢ় করে।
২০২৫ সালের মহাসপ্তমীর প্রস্তুতি: আপনার করণীয়
১. পরিকল্পনা: কোন কোন মণ্ডপে যাবেন, তার একটি তালিকা আগে থেকেই তৈরি করে নিন।
২. পোশাক: মহাসপ্তমীর দিন সাদা বা হলুদ রঙের পোশাক পরাকে শুভ মনে করা হয়। আপনি সাধ্যমতো নতুন বা পরিষ্কার পোশাক পরতে পারেন।
৩. প্রসাদ: বাড়িতে প্রসাদ তৈরি করুন কিংবা বাইরে থেকে সংগ্রহ করুন। ভক্তিভরে প্রসাদ গ্রহণ করুন।
৪. সতর্কতা: ভিড়ের মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের দিকে বিশেষ নজর দিন। মানিব্যাগ ও জিনিসপত্র সুরক্ষিত রাখুন।
উপসংহার
মহাসপ্তমী হল শুভের সূচনা, মঙ্গলের আবাহন। এটি আমাদের অন্তরে সাহস, শক্তি ও নবীন উদ্দীপনার সঞ্চার করে। ২০২৫ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর আসুন সকলেই মিলে দেবী দুর্গার চরণে নিজেকে সমর্পণ করি। তাঁর আশীর্বাদে আমাদের জীবন হয়ে উঠুক সমৃদ্ধ ও মঙ্গলময়।
শুভ মহাসপ্তমী!
Comments
Post a Comment